আশুরা, যা হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকে নির্দেশ করে, ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দিনটি পৃথিবীর সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর সাথে জড়িত। মহররম মাসটি ইসলামের অন্যতম সম্মানিত মাস হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এই মাসে সংঘটিত কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা আশুরার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।
আশুরায় ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনা
আশুরার দিনটি ইসলামের ইতিহাসে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। এ দিনটিতে সংঘটিত কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ:
১. হজরত আদম (আ.) এর সৃষ্টি ও পৃথিবীতে অবতরণ
হজরত আদম (আ.) কে মহান আল্লাহ আশুরার দিনেই সৃষ্টি করেন। তার অবাধ্যতার কারণে তাকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করা হয়। তিনি ও তার সহধর্মিণী হাওয়া (আ.) আশুরার দিনেই পৃথিবীতে নতুন করে জীবন শুরু করেন এবং পরে তাদের তাওবা কবুল হয়।
২. হজরত মুসা (আ.) এর বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া
আশুরার দিনেই হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর আদেশে বনি ইসরাইলদের নিয়ে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে পালিয়ে যান। আল্লাহর মুজিজায় তিনি লোহিত সাগর দ্বিখণ্ডিত করে বনি ইসরাইলদের নিরাপদে পার করে দেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনী সাগরে ডুবে যায়।
৩. হজরত নুহ (আ.) এর নৌযানের যাত্রা আরম্ভ এবং বন্যা-প্লাবনের সমাপ্তি
হজরত নুহ (আ.) কে আল্লাহ আশুরার দিনেই মহাপ্লাবনের পূর্বাভাস দেন এবং তাকে একটি নৌকা তৈরি করতে বলেন। এই দিনেই তার নৌযান সমুদ্রযাত্রা আরম্ভ করে এবং আশুরার দিনেই বন্যা-প্লাবনের সমাপ্তি ঘটে, নৌযানটি জুদি পাহাড়ে এসে থামে।
৪. হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর নমরুদের অগ্নিকান্ড থেকে মুক্তি পাওয়া
আশুরার দিনেই হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশে মূর্তিপূজারী নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হন। আল্লাহর মুজিজায় আগুন তার জন্য ঠান্ডা হয়ে যায় এবং তিনি সুস্থভাবে অগ্নিকুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসেন।
৫. হজরত আইয়ুব (আ.) এর রোগ মুক্তি
হজরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘদিন রোগে ভুগছিলেন। আশুরার দিনেই আল্লাহ তার রোগ মুক্তি দেন এবং তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলেন।
৬. হজরত ইউনুস (আ.) এর মাছের পেট থেকে মুক্তি
হজরত ইউনুস (আ.) আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে একটি বৃহৎ মাছের পেটে বন্দী হন। আশুরার দিনেই আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন এবং তাকে মাছের পেট থেকে মুক্ত করেন।
৭. কারবালার প্রান্তরে হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত
৬১ হিজরিতে আশুরার দিন কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) এবং তার সঙ্গী-সাথীরা ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। এই দিনটি ইসলামের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
আশুরার বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা
মহররম মাসের ১০ তারিখে আশুরার দিন রোজা রাখা একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। ইসলাম-পূর্ব যুগেও মদিনার ইহুদিরা ও মক্কার কোরাইশরা এ দিন রোজা রাখত। নবী করিম (সা.) আশুরার রোজার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন এবং আশুরার দিনে রোজা রাখার জন্য উম্মতদের উৎসাহিত করেছেন। আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, “আল্লাহর প্রতি আমার ধারণা হলো আশুরার দিন রোজার বিনিময়ে তিনি এক বছর আগের গোনাহ মাফ করে দেবেন।” (মুসলিম)।
আশুরায় করণীয় কাজ
- রোজা রাখা: নবী করিম (সা.) আশুরার রোজা রাখার জন্য বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। মহররমের ৯-১০ তারিখ বা ১০-১১ তারিখে রোজা রাখা উচিত।
- দান-সদাকাহ করা: আশুরার দিনে দান-সদাকাহ করা এবং গরিবদেরকে পানাহার করানো অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।
- ইবাদত করা: নফল নামাজ পড়া, তাওবা-ইস্তিগফার করা এবং দরুদ শরিফ পড়া।
- ইফতার করানো: যারা রোজা রাখবেন তাদের ইফতার করানো।
- ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলানো: ইয়াতীমদের সাথে সহানুভূতি প্রকাশ করা।
আশুরায় বর্জনীয় কাজ
- ক্রন্দন-বিলাপ করা: আশুরার দিন ক্রন্দন-বিলাপ করা, বুকে চাপড়ানো, পিঠে চাবুক দিয়ে আঘাত করা, নিজেকে রক্তাক্ত করা ও শোক মিছিল করা শরিয়তসম্মত নয়।
- তা’যিয়া বানানো: তা’যিয়া বানানো, তা’যিয়ার সামনে নযর-নিয়ায পেশ করা এবং তা’যিয়ার সাথে ঢাক-ঢোল বাজানো।
- মর্সিয়া বা শোকগাঁথা পাঠ করা: মর্সিয়া বা শোকগাঁথা পাঠ করা, মজলিস করা এবং তাতে অংশগ্রহণ করা।
- মিথ্যা ও জা‘ল হাদীস বর্ণনা করা: আশুরার দিনের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে মিথ্যা ও জা‘ল হাদীস বর্ণনা করা।
- শিরক, বিদ‘আত ও গুনাহ: শিরক, বিদ‘আত ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকা।
আল্লাহ এই মহান দিনে সংঘটিত ঘটনার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা নেয়ার তাওফিক দান করুন এবং আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন এবং কুসংস্কার ও নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড থেকে বাঁচার তাওফীক দিন। আশুরার মূল তাৎপর্য ও ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা যেন আমাদের জীবনকে আরও পবিত্র ও নেক আমলের মাধ্যমে আলোকিত করতে পারি।
লেখক: ইবনে আবদুল্লাহ
সূত্র: SL/Dorshok24.com/Re17724