ঢাকা, বাংলাদেশের রাজধানী, একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহর। ভূগোলের দিক থেকে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অবস্থিত, যা এটিকে শতাব্দী ধরে বাণিজ্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। ঢাকা শহরের ইতিহাস ছয় হাজার বছরেরও বেশি পুরনো এবং এই দীর্ঘ সময় ধরে এটি বিভিন্ন রাজবংশ ও সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেছে।
প্রাচীন ইতিহাস:
ঢাকার অঞ্চলে মানুষের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে ৬ষ্ঠ শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে। তখন এটি ‘পুণ্ড্রবর্ধন’ নামে পরিচিত ছিল এবং এটি গৌড় রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। ৭ম শতাব্দীতে, ঢাকা পাল রাজাদের অধীনে আসে, যারা শহরটিকে তাদের রাজধানী করে তোলে। পাল রাজাদের অধীনে, ঢাকা শিল্পকলা, সাহিত্য এবং বৌদ্ধ ধর্মের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়।
মধ্যযুগীয় ইতিহাস:
১২০৪ সালে, ঢাকা সেন রাজাদের হাতে চলে যায়। সেন রাজারাও ঢাকাকে তাদের রাজধানী করে তোলে এবং শহরে অনেক মন্দির ও প্রাসাদ নির্মাণ করে। ১৩৪৩ সালে, ঢাকা মুসলিম শাসক ইলিয়াস শাহের অধীনে আসে। মুসলিম শাসনামলে, ঢাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়। মুঘল আমলে, ঢাকা বাংলার সুবাহ্দারের রাজধানী ছিল এবং এটি একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত শহর ছিল।
মুঘল আমল
ঢাকার স্বর্ণযুগ ছিল মুঘল শাসনামলে, বিশেষ করে ১৭শ শতাব্দীতে যখন শহরটি সুবেদার ইসলাম খানের অধীনে ছিল। ১৬০৮ সালে ইসলাম খান বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করেন। এই সময়ে, শহরটি “জাহাঙ্গীরনগর” নামে পরিচিত ছিল এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ঢাকায় মুঘল আমলের অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে, যেমন লালবাগ কেল্লা, হোসেনী দালান, এবং চাঁন মসজিদ।
ব্রিটিশ আমল
১৭৫৭ সালে প্লাসির যুদ্ধে ব্রিটিশরা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করার পর, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে। ব্রিটিশ আমলে ঢাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক কেন্দ্র ছিল এবং এখানে পাটের ব্যবসা খুবই প্রসারিত হয়েছিল। ১৯০৫ সালে ঢাকা পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী হয়, তবে ১৯১২ সালে পুনরায় কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।
পাকিস্তান আমল
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর, ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) রাজধানী হয়। এই সময়ে, ঢাকায় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায় এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হয়। ঢাকাই বাংলাদেশের রাজধানী এবং দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে, ঢাকা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি আজ একটি আধুনিক মহানগরীতে পরিণত হয়েছে।
ঢাকার সংস্কৃতি:
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী, কেবল একটি শহর নয়, এটি ঐতিহ্য, বৈচিত্র্য ও ঐক্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। ঢাকার সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। শহরে বিভিন্ন ধর্ম, জাতি এবং ভাষার মানুষ বাস করে। ঢাকার সংস্কৃতিতে বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সাথে মুসলিম ও ব্রিটিশ সংস্কৃতি এই শহরকে সমৃদ্ধ করেছে, যার ফলে ঢাকার সংস্কৃতি অতুলনীয় রূপ পেয়েছে। ঢাকা শহরটি তার সাহিত্য, সঙ্গীত, নাট্য, চলচ্চিত্র এবং শিল্পের জন্য বিখ্যাত। ঢাকার খাবারও অত্যন্ত জনপ্রিয়, যার মধ্যে রয়েছে বিরিয়ানি, কাবাব, ইলিশ মাছের ঝোল, এবং রসগোল্লা।
ঢাকার দর্শনীয় স্থান:
ঢাকায় অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
* লালবাগ কেল্লা: মুঘল আমলের একটি প্রাসাদ
* আহসান মঞ্জিল: নবাবদের প্রাসাদ
* জাতীয় জাদুঘর: বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে
* শহীদ মিনার: বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে নির্মিত
* বোটানিক্যাল গার্ডেন: বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা দেখার জন্য
* রমনা পার্ক: শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি বড় পার্ক
* চক বাজার: ঐতিহ্যবাহী বাজার
* আর্ট ইনস্টিটিউট: বাংলাদেশের শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শন
ঢাকা তার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এটি বাংলার গর্ব এবং কালের সাক্ষী হিসেবে একটি অমূল্য ভাণ্ডার।
সূত্র: SL/Dorshok24.com/bd11724